প্রতিবন্ধী কত প্রকার: একটি বিস্তৃত আলোচনা

আমাদের সমাজে প্রতিটি মানুষই সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তবে শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক মানুষকে প্রতিদিন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এই মানুষদের আমরা সাধারণত ‘প্রতিবন্ধী’ বলে থাকি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—প্রতিবন্ধী কত প্রকার এবং কীভাবে এদের শ্রেণিবদ্ধ করা হয়? এই বিষয়টি জানা শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং নীতি নির্ধারণ, শিক্ষা, চাকরি ও সমাজিক সহায়তার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবন্ধিতা কী?

প্রতিবন্ধিতা হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা সংবেদনশীল সীমাবদ্ধতার কারণে একজন ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনযাপন বা সামাজিক অংশগ্রহণে অসুবিধার সম্মুখীন হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্রতিবন্ধিতা কেবল একটি শারীরিক অবস্থা নয়, বরং এটি একটি জটিল সামাজিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি ও পরিবেশের মাঝে অসঙ্গতি দেখা দেয়।

প্রধান প্রতিবন্ধিতার ধরন

১. শারীরিক প্রতিবন্ধিতা

এটি সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতিবন্ধিতা। হাত, পা, চলাফেরার অক্ষমতা, দৃষ্টিহীনতা বা শ্রবণশক্তির অভাব—এই সকল সমস্যাকে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা বলা হয়। অনেক সময় জন্মগত আবার কখনো দুর্ঘটনার ফলে এটি হতে পারে।

২. মানসিক প্রতিবন্ধিতা

মানসিক প্রতিবন্ধিতা বলতে বোঝায় বুদ্ধিবৃত্তিক বা জ্ঞানীয় সীমাবদ্ধতা। যারা জটিল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কিংবা মেধার ঘাটতির কারণে স্বাভাবিকভাবে সমাজে মিশতে পারেন না—তাদের এই শ্রেণিতে ফেলা হয়। যেমন: ডাউন সিনড্রোম, অটিজম, সেরিব্রাল পালসি প্রভৃতি।

৩. শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধিতা

অনেকেই জন্মগতভাবে শুনতে বা কথা বলতে পারেন না। শ্রবণশক্তি হ্রাস বা বাকপ্রতিবন্ধিতা—এই দুটি ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা সহায়তা প্রয়োজন হয়, যেমন সংকেতভাষা, হিয়ারিং এইড, বা স্পিচ থেরাপি।

৪. দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা

এই শ্রেণিতে পড়েন যারা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতি, হোয়াইট ক্যান বা দৃষ্টিসহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫. স্নায়বিক প্রতিবন্ধিতা

এটি একটি তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ধরণ। যারা স্নায়বিক সমস্যার কারণে চলাফেরা, যোগাযোগ, স্মৃতিশক্তি বা চিন্তাভাবনায় ব্যাঘাত অনুভব করেন, তাদের এই দলে রাখা হয়। এপিলেপসি, পারকিনসন, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস ইত্যাদি এই ধরনে পড়ে।

অন্যান্য বিশেষ ধরণের প্রতিবন্ধিতা

১. বহুবিধ প্রতিবন্ধিতা

কিছু ব্যক্তি একাধিক ধরণের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জন্মান বা পরবর্তীতে আক্রান্ত হন, যেমন দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির অভাব একসাথে। তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা ও যত্নের প্রয়োজন হয়।

২. মানসিক রোগ সংশ্লিষ্ট প্রতিবন্ধিতা

মানসিক রোগ যেমন: বিষণ্ণতা, স্কিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার—এই ধরণের রোগ দীর্ঘমেয়াদি হলে ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাপন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তখন এটিকে প্রতিবন্ধিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সহায়তা

শিক্ষা

বাংলাদেশে এখন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় ও ইনক্লুসিভ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। অনেক বিদ্যালয় এখন সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে।

চাকরি

সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটার ব্যবস্থা রয়েছে। দক্ষতা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের চাকরির উপযোগী করে তোলা হচ্ছে।

ভাতা ও সরকারি সহায়তা

বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ভাতা, চিকিৎসা সহায়তা ও চলাফেরার উপযোগী সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে এই সুবিধাগুলো দেওয়া হয়।

উপসংহার

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধিতা শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়, বরং এটি একটি সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। আমরা যদি জানি প্রতিবন্ধী কত প্রকার, তাহলে তাদের বোঝা, সহায়তা করা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। প্রতিটি মানুষই বিশেষ, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান—এই উপলব্ধিই আমাদের সমাজকে আরও মানবিক করে তুলবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *